বিশেষ প্রতিনিধি।
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনিসুল করিমকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় হাসপাতালের দোতলায় নিয়ে যান। এরপর তাকে মারতে মারতে অবজারভেশনরুমে ঢোকানো হয়। আনিসুল করিম মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার এজাহারে বাদী এমন তথ্য তুলে ধরেছেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘আমার ছেলে আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার। আমার ছেলে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) হিসেবে কর্মরত ছিল। গত তিন-চার দিন যাবৎ হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে যায়। পরিবারের সবার মতামত অনুযায়ী তাঁকে চিকিৎসা করানোর জন্য গত ৯ নভেম্বর প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাই। অতঃপর আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য একই দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আরিফ মাহমুদ জয়, রেদোয়ান সাব্বির ও ডা. নুসরাত ফারজানা আনিসুল করিমকে হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া করতে থাকেন। ওই সময় আমার ছেলে হাসপাতালের সব স্টাফদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে। হাসপাতালের নিচতলায় একটি রুমে বসে হালকা খাবার খায়। খাবার খাওয়ার পর আমার ছেলে ওয়াশরুমে যেতে চায়। বেলা পৌনে ১২টার দিকে আরিফ মাহমুদ জয় আমার ছেলেকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হাসপাতালের দোতলায় নিয়ে যায়। তখন আমার মেয়ে উম্মে সালমা আমার ছেলের সঙ্গে যেতে চাইলে আসামি আরিফ মাহমুদ জয় ও রেদোয়ান সাব্বির বাধা দেয় এবং কলাপসিবল গেট আটকে দেয়। তখন আমি, আমার ছেলে রেজাউল করিম ও মেয়ে ডা. উম্মে সালমা (সাথী) নিচতলায় ভর্তি প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলাম। এরপর এজাহারে উল্লিখিত আসামিসহ আরো অজ্ঞাতনামা কয়েকজন আমার ছেলে আনিসুল করিমকে চিকিৎসার নামে দোতলার একটি ‘অবজারভেশনরুমে’ (বিশেষভাবে তৈরি কক্ষ) নিয়ে যায়।
আসামিরা আমার ছেলেকে চিকিৎসা করার অজুহাতে অবজারভেশনরুমে মারতে মারতে ঢোকায়। তাকে ওই রুমের ফ্লোরে জোরপূর্বক উপুড় করে শুইয়ে তিন-চারজন হাঁটু দ্বারা পিঠের ওপর চেপে বসে, কয়েকজন আমার ছেলেকে পিঠমোড়া করে ওড়না দিয়ে দুই হাত বাঁধে। কয়েকজন আসামি কনুই দিয়ে আমার ছেলের ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় আঘাত করে। একজন মাথার ওপরে চেপে বসে এবং আসামিরা সবাই মিলে আমার ছেলের পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মেরে আঘাত করে।
এরপর দুপুর ১২টার দিকে আমার ছেলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। যা হাসপাতালে স্থাপিত সিসিটিভির ভিডিও ফুটেজে দৃশ্যমান। নিস্তেজ হয়ে যাওয়ার পর আসামি আরিফ মাহমুদ জয় নিচে এসে আমাদেরকে ইশারায় ওপরে যাওয়ার জন্য ডাক দেয়। আমি আমার ছেলে ও মেয়েসহ অবজারভেশনরুমে গিয়ে আমার ছেলেকে ফ্লোরে নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখতে পাই। অতঃপর জরুরি ভিত্তিতে আমার ছেলেকে একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্সে করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার পরীক্ষা করে আমার ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন।
এজাহারে আরো বলা হয়, আসামিরা দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার নামে অর্থ উপার্জনের একটি অনুমোদনহীন অবৈধ এবং অসৎ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। এজাহারের ১১ থেকে ১৫ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিদের ব্যবস্থাপনায়, পৃষ্ঠপোষকতা ও প্ররোচনায় ১-১০ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিরাসহ তাদের কয়েকজন অজ্ঞাতনামা সহযোগী আসামিরা পরিকল্পিতভাবে আমার ছেলেকে চিকিৎসা দেওয়ার নামে অবজারভেশনরুমে নিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করে মৃত্যু ঘটায়।
এর আগে মঙ্গলবার আদাবর থানায় আনিসুল করিম শিপনের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তাদের মধ্যে গ্রেপ্তার দশ আসামিকে সাত দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
তারা হলেন, মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন সেফ মো. মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট মো. তানভীর হাসান, ওয়ার্ড বয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, মো. লিটন আহাম্মদ, মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ।
এ ছাড়া এ মামলায় পাঁচ আসামি পলাতক রয়েছে। তারা হলেন, মুহাম্মাদ নিয়াজ মোর্শেদ, মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, মো. সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন, মোছা. ফাতেমা খাতুন ময়না।